ঢাকা,রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

চট্টগ্রাম নগরে ‘বাইকস্টার যন্ত্রণা’

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি ::

সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রাম নগরে একশ্রেণির কিশোরের হাওয়ার গতিতে মোটরসাইকেল চালনায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এরা প্রায়ই ঘটাচ্ছে দুর্ঘটনা। এতে ঘটছে অকাল মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ববরণের মতো ঘটনা। দুর্ঘটনায় শুধু চালক আহত বা নিহত হয় না, নিরীহ পথচারীর জীবনও হয় সংকটাপন্ন।

ওরা দুরন্ত। ওরা কিশোর। ওদের কাছে জীবন মানেই উড়ন্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে চলা। তাই ওরা উড়তে চায় নগরের ব্যস্ততম সড়কে। দুই চাকার মোটরসাইকেল নিয়ে ওরা ছুটে হাওয়ার গতিতে। মাঝে-মধ্যে স্টিয়ারিং ছেড়ে দুই হাত দিয়ে ডানা মেলে শূন্যে! এর পর শরীরের ভারসাম্য দিয়েই রক্ষার চেষ্টা করে মোটরসাইকেল। ফলাফল মারাত্মক দুর্ঘটনা। ঘটে অকাল মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ববরণের মতো ঘটনা। এতে শুধু বাইক চালকদের প্রাণ যায় না, পথচারীর জীবনও হয় মরণাপন্ন।

এমন দুরন্তপনায় এবার লাগাম টেনে ধরতে শুরু করেছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। এ কারণে শুরু হয়েছে দুরন্তপনায় জড়িত মোটরসাইকেলবিরোধী অভিযান। অভিযানে ধরা পড়ছে সেই সব ‘বাইকস্টার’ যারা কোনো প্রকার নিয়মনীতি না মেনেই সড়কে গাড়ি চালাচ্ছে কিংবা দ্রুত গতিতে গাড়ি ও উচ্চৈঃস্বরে হর্ন বাজিয়ে জনজীবন দুর্বিষহ করে তোলছে।

এই ‘বাইকস্টার’ দুরন্তপনা কেমন? তা দেখা গেছে নগরের বিভিন্ন সড়কে। সমপ্রতি দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে এক সন্ধ্যায় রেইস করতে বের হয় চার যুবক। চন্দনপুরা থেকে বের হয়ে গণি বেকারির দিকে আসার পথে দুটি মোটরসাইকেলের গতি যেন ১০০ কিলোমিটারের বেশিই। চোখের পলকেই গাড়ি দুটি এগিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে সড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক পথচারীর হাতে লাগে একটি মোটরসাইকেলের লুকিং গ্লাস। জোরে শব্দ করে তিনি পড়ে যান সড়কের পাশে। কিন্তু বাইকস্টারদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ওরা এগিয়ে যায়। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে সামনের মোড়ে। পেছনের বাইকস্টার সামনের বাইকস্টারকে ওভারটেক করতে গিয়েই পড়ে যায় সড়কে। বিকট শব্দ হয়। পরক্ষণে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন তাদের উদ্ধারে। মাত্র ৫০ গজ দূরত্বে যে ব্যক্তি হাতের ব্যথায় কাতর, তিনিও দেখছিলেন পড়ে যাওয়া ‘বাইকস্টারকে’। রক্তাক্ত শরীর। একটি অটোরিকশায় তোলে বাইকস্টারকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো হাসপাতালে।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় দেখা গেল, কাজির দেউড়ি মোড় অতিক্রম করে দ্রুতগতির একটি মোটরসাইকেলে চড়ে দুজন যাচ্ছে সার্কিট হাউসের দিকে। পেছনে বসা তরুণ দুই হাত প্রসারিত করেছে শূন্যে। পাখির মতো ডানা মেলে যেন হাওয়ায় ছুটছে তারা। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে-সামনে সড়ক পারাপাররত এক নারী সামনে পড়ে যায়। কাজির দেউড়ি ব্র্যাক ব্যাংকের সামনে থেকেই তিনি বাজারে প্রবেশ করছিলেন। মুহূর্তেই ‘বাইকস্টারের’ ধাক্কায় তিনি ছিটকে পড়েন একটি চলন্ত রিকশার ওপর। মোটরসাইকেলের সামনের চাকার ‘চাপ’ পড়ে ওই নারীর বাম পা দিয়ে রক্ত বের হয়। আর মুখসহ হাত রক্তাক্ত হয় চলন্ত রিকশার ধাক্কায়। পরক্ষণে আশপাশের লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে ডাক্তারের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ‘বাইকস্টার’ ঘটনার পর সেখানে না দাঁড়িয়ে আরো দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে যায়। ফলে ‘বাইকস্টার’ ধরা পড়েনি।

এদিকে এসব ‘বাইকস্টার’ ধরতে পুলিশের অভিযান শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মহসিন।  সোমবার দুপুরে সংবদ মাধ্যমের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘গত ১৯ জুন থেকে কোতোয়ালী থানা পুলিশ বাইকস্টার ধরার অভিযান শুরু করে। এরপর থেকে প্রতিদিনই চলছে অভিযান। এই পর্যন্ত ৫৮৫ টি মোটরসাইকেলের কাগজপত্র তল্লাশি করা হয়েছে। এরমধ্যে ১৩৪টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ১৯টি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে। এসব গাড়ির কোনো ধরনের কাগজপত্র নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘বাইকস্টাররা নিজেদের মতো করে গাড়ি চালাতে গিয়ে অন্যের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এছাড়া অনেকের লাইসেন্স ও গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। তারা দুই তিনজন যুবক এক সঙ্গে গাড়ি চালায়। হেলমেটও পরে না। নিজদের নিরাপত্তা ঝুঁকি তো থাকে, পথচারীসহ অন্য গাড়িচালক-যাত্রীর জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলে বাইকস্টাররা। এই কারণেই উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযান চলমান থাকবে।’

নগর পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অভিযান পুরো নগরীতেই চলছে। সব থানা পুলিশ এখন মোটরসাইকল তল্লাশি চালাচ্ছে। এর মধ্যে বেশি ধরা পড়ছে কাগজপত্রবিহীন গাড়ি। ভারত সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে পার হয়ে বাংলাদেশে আনা হয়েছে অনেক মোটরসাইকেল।

রেজিস্ট্রেশন নম্বরবিহীন এসব গাড়ি নগরীতে চলছে। চালকদের লাইসেন্সও নেই অনেক ক্ষেত্রে। এই কারণে নগরীতে একযোগে অভিযানের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী, বাইকস্টারদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। বাইকস্টারদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হলে সড়ক দুর্ঘটনাও কমে আসবে বলে মনে করছে পুলিশ।

 

পাঠকের মতামত: